ধৃষ্টতা দেখাবেন না, বিশৃঙ্খলা করতে দেবো না : প্রধানমন্ত্রী

ধৃষ্টতা দেখাবেন না, বিশৃঙ্খলা করতে দেবো না : প্রধানমন্ত্রী

ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার না করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকারকে ভ্রুকুটি দেখানোর পর্যন্ত ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। ধর্মের নামে কোনো ধরনের বিভেদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে দেবো না।


একাত্তরের পরাজিত শক্তির একটি অংশ সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করতে মাঠে নেমেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭১’র পরাজিত শক্তির একটি অংশ মিথ্যা, বানোয়াট, মনগড়া বক্তব্য দিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে ইদানীং মাঠে নেমেছে। সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে।

জাতির পিতা ১৯৭২ সালে বলেছিলেন ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার না করতে। কিন্তু পরাজিত শক্তির দোসররা দেশকে আবার ৫০ বছর আগের অবস্থায় ফিরে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। রাজনৈতিক মদদে সরকারকে ভ্রুকুটি দেখানোর পর্যন্ত ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। 

হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, এদেশে ধর্মের নামে আমরা কোনো ধরনের বিভেদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে আমরা দেবো না। ধর্মীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে এদেশের মানুষ প্রগতি, অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবেন।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, ধর্মান্ধ নয়। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করবেন না। প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রাখেন। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান- সব ধর্মের-বর্ণের মানুষের রক্তের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে।

এ বাংলাদেশ লালন শাহ, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দের বাংলাদেশ। এ বাংলাদেশ শাহজালাল, শাহ পরান, শাহ মখদুম, খানজাহান আলীর বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ শেখ মুজিবের বাংলাদেশ, সাড়ে ষোল কোটি বাঙালির বাংলাদেশ। এ দেশ সবার।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন খাঁটি মুসলমান ছিলেন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা শুধু একজন খাঁটি মুসলমানই ছিলেন না, তিনি ধর্মীয় আচারাদি নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিপালন করতেন।  

তিনি বলেন, তাঁর (বঙ্গবন্ধু) মতো আর কে বাংলার মানুষের মন-মনন-আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পারতো! তাই তিনি যখন সংবিধান রচনা করেন, তখন মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র- এই চারটি মৌলিক বিষয়কে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেন।

বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী জাতির পিতা ইসলাম ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষা এবং প্রসারে যা করেছেন, ইসলামের নামে মুখোশধারী সরকারগুলো তা কখনই করেনি।

‘আইন করে মদ-জুয়া-ঘোড়দৌড় নিষিদ্ধ করা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা, মাদ্রাসা বোর্ড স্থাপন, ওআইসির সদস্যপদ অর্জনের মতো কাজগুলো বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই বাস্তবায়িত হয়েছিল স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে।

৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, দুঃখের বিষয় ৭৫-পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী সরকারগুলো মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মূল্যবোধগুলোকে জলাঞ্জলি দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় নিজেদের আসন চিরস্থায়ী করার পদক্ষেপ করে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধারাবাহিক অপপ্রচার চালিয়ে, ইতিহাস বিকৃত করে আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কালিমা লেপনের চেষ্টা করে।

বিগত কয়েক টার্মে আওয়ামী লীগ সরকার আমলের কথা তুলে ধরে টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার সরকার ধর্মীয় শিক্ষা প্রচার এবং প্রসারে যত কাজ করেছে, অতীতে কোনো সরকারই তা করেনি। আমরা ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছি। ৮০টি মডেল মাদ্রাসায় অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দিয়েছি এবং দাওয়ারে হাদিস পর্যায়কে মাস্টার্স মান দেওয়া হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছি। প্রতিটি জেলা-উপজেলায় দৃষ্টিনন্দন মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। ইমাম-মোয়াজ্জিনদের সহায়তার জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে দিয়েছি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আওতায় সারাদেশে মসজিদ-ভিত্তিক পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে। লক্ষাধিক আলেম-ওলামায়ে কেরামের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

কোভিড-১৯ মহামারি পরিস্থিতির মধ্যেও সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ পূর্ণগতিতে চলছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই বছরটি শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ববাসীর জন্য দুর্যোগময় বছর হিসেবেও উল্লেখ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের বৃহৎ প্রকল্পগুলোর কাজ পূর্ণগতিতে এগিয়ে চলেছে। আমাদের স্বপ্নের ও গর্বের পদ্মাসেতুর সবগুলো স্প্যান বসানো শেষ। ঢাকায় মেট্রোরেলের কাজ আবার পুরোদমে শুরু হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ এই মহামারিতে একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি।

কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর নদীর তলদেশে ট্যানেল নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের মহাসড়কগুলো চার লেনে উন্নয়নের কাজও পুরোদমে এগিয়ে চলছে।

করোনা মহামারি পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এ বছরটি শুধু আমাদের জন্যই নয়, বিশ্ববাসীর জন্য এক দুর্যোগময় বছর। করোনা ভাইরাসের মহামারি স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার পাশাপাশি অর্থনীতির উপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিশ্ব অর্থনীতি এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। করোনা ভাইরাসের মহামারির ফলে অনেক উন্নত এবং উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির মুখে পড়েছে।

বাংলাদেশে আমরা সময়োচিত পদক্ষেপ ও কর্মসূচি গ্রহণ করে এই নেতিবাচক অভিঘাত কিছুটা হলেও সামাল দিতে সক্ষম হয়েছি।

কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাকিলায় সরকারের নানাবিধ পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা প্রায় ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি যা জিডিপির ৪.৩ শতাংশ। বিভিন্ন পেশার প্রায় ২.৫ কোটি প্রান্তিক মানুষকে নগদসহ নানা সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

প্রাথমিক ধাক্কা সামলিয়ে আমাদের প্রবাসী আয়, কৃষি উৎপাদন ও রপ্তানি বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন,  বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। গত অর্থবছরে ৫.২৪ শতাংশ হারে আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রক্ষেপণ বলছে ২০২০ সালে বাংলাদেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি হবে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ।

সবশেষে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মহান বিজয় দিবস পালনের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।