বুকার জয়ী এক কালজয়ী উপন্যাসের মর্মস্পর্শী কাহিনি

বুকার জয়ী এক কালজয়ী উপন্যাসের মর্মস্পর্শী কাহিনি

সময়টা ১৯৮১, গ্লাসগো, স্কটল্যান্ড। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার। তার নতুন গৃহীত কিছু পদক্ষেপের কারণে শ্রমজীবী শ্রেণি এক অকুল পাথারে– এমনই এক পরিবেশে আমরা ‘শাগি বেইন’ এর দেখা পাই। ডগলাস স্টুয়ারটের প্রথম উপন্যাসটি আমাদের এক নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি করে- যেখানে আশা নিজেই নিরাশ।

অ্যাগ্নেস বেইন সমাজের স্পষ্ট চরিত্র বহন করে। তিনি বাইরের সজ্জায়-চুল কালো রঙ করে রাখেন, নকল দাঁত ব্যবহার করেন এবং সব সময় মেকআপ করে থাকেন। তবে কিছুই তাকে তার মদ খাওয়ার সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে না। তাকে উপন্যাসটির ‘লাইফ ব্লাড’ বলা যেতে পারে, কারণ গল্পটিও নিউইয়র্ক টাইমস বুক রিভিউর মতে ‘ক্রেজিলি অ্যান্ড ইমপ্রোবাবোলি অ্যালাইভ’।   

অ্যাগ্নেস বেইন-এর স্বামীর নাম হিউ ‘শাগ’ বেইন। শাগ একজন উড়নচণ্ডী ট্যাক্সিচালক। শাগের তিন সন্তান- ক্যাথেরিন, লিক এবং হিউ, যাকে আমরা ‘শাগি’ নামে চিনি। ‘হিউ’ নামের কাউকে ‘শাগ/শাগি’ নামে ডাকা  স্কটল্যান্ডের একটি আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য। তারা স্লাইটহিলে অ্যাগ্নেসের বাবা-মায়ের বাসায় থাকে। তাদের নাম উইলি এবং লিজি।

শাগ একজন অবিশ্বস্ত স্বামী। সে অ্যাগ্নেসকে বলে যে তারা নিজেদের বড় বাসা নেবে। শাগ অবশ্য বাচাল প্রকৃতির। তবু অ্যাগ্নেসের কথাটি মনে ধরে। সে নিজেদের একটা সামনের দিকে দরজাওয়ালা বড় বাসার স্বপ্ন দেঠিক করে দিন

খে। অ্যাগ্নেসের বিশ্বাস, পরিবেশ পরিবর্তন হলে তাদের সবার জন্যই ভালো। এটি অবশ্য তার একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য- ছোট ছোট ‘ম্যাটেরিয়ালিস্টিক’ চাহিদা, কিছুটা আরামপ্রিয়তা, কিছুটা লোকদেখানো।

নতুন ঠিকানা হিসেবে শাগ তাদের নিয়ে পিটহেডে যায়। এখানে তারা কয়লাখনির শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ কলোনিতে থাকা শুরু করে। ক্ষমতায় আসার পর, মার্গারেট থ্যাচার জাহাজনির্মাণ, কয়লা উত্তোলন, গাড়ি নির্মাণ জাতীয় ‘ভারী শিল্প’ বেসরকারি খাতে দিয়ে দেন। আগে এগুলো সরকারি খাতে ছিল। এসব শিল্পে প্রসিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও অনেক কারখানাই যুক্তরাজ্যের বাইরে চলে যায় এবং আঞ্চলিক শ্রমজীবী শ্রেণি পথে বসে পড়ে। সম্পূর্ণ যুক্তরাজ্যে বেকারত্বের হার দাঁড়ায় ১৪ শতাংশে। গ্লাসগোতে যা ছিল ২৬ শতাংশ। এ অঞ্চলটিও এমনই এক মৃত্যু উপত্যকা।

শাগ তাদের পিটহেডে ছেড়ে চলে যায়। অ্যাগ্নেসের মদ খাওয়া বেড়ে যায়। ক্যাথেরিন তাকে ছেড়ে অল্প বয়সেই বিয়ে করে সাউথ আফ্রিকা চলে যায়। একদিন মদের ঘোরে সে লিককে লাথি মেরে বাসা থেকে বের করে দেয়। এসবের পরও শাগি তার মায়ের সঙ্গে ছিল। কারণ শাগি এবং অ্যাগ্নেস আসলে একই সত্তা।

শাগির মাঝে তার মায়ের চারিত্রিক গুণাবলির অনেক কিছুই প্রকট। সে তৎকালীন (শ্রমজীবী) সমাজের ‘স্বাভাবিক’ পুরুষদের মতো না। তবুও সে তার মায়ের জন্য নিজেকে ‘স্বাভাবিক’ প্রমাণ করার চেষ্টা করে। তার মধ্যেও একটা ‘পরিপূর্ণ’ হতে চাওয়ার লক্ষণ চোখে পড়ে। তবে এর জন্য জিনগত বৈশিষ্ট্য ছাড়াও সামাজিক আবহ দায়ী। সে ‘ঠিক না’– এ রকম একটা পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করা একটা বাচ্চার জন্য খুব ভালো অভিজ্ঞতা না। অ্যাগ্নেস তাকে ভালোবাসে, তবে মদের চেয়ে বেশি নয়।


প্রথম উপন্যাসে সাধারণত কিছুটা হলেও লেখকের নিজের জীবনের ছায়া থাকে। এ ক্ষেত্রেও কি তাই? ডগলাস স্টুয়ারটের নিজের ভাষ্যমতে, তিনিও ছোটবেলায় আর্থিক কষ্ট দেখেছেন। তার মা ‘অ্যালকহোলিক’ ছিলেন এবং এ কারণে স্টুয়ারটের বয়স যখন ১৬, তিনি মারা যান। নিজের ‘কুইর সেকচুয়ালিটি’ নিয়েও খোলাসা করে কথা বলেছেন স্কটিশ-আমেরিকান এই ভদ্রলোক। তবে, ‘লেখা শুরু করার পর আমি দেখলাম যে, আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এ চরিত্রগুলোর অভিজ্ঞতার কাছে খুব সামান্য। সে ক্ষেত্রে আমি এটিকে “ফিকশন” ই বলব।’

বুকার গ্রহণের সময় ডগলাস বলেন, ‘আমি বাক্রুদ্ধ’ । আমি এটা একদমই আশা করিনি। প্রথমত, আমি আমার মাকে ধন্যবাদ দিতে চাই। সম্পূর্ণ বইটা জুড়েই আমার মা আছেন। তিনি না থাকলে আমি থাকতাম না, আমার বইও থাকত না- এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।’

উপন্যাসটি লিখতে তিনি দশ বছর সময় নেন এবং ৩০ জনের বেশি এডিটর তার লেখাটি প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাজ্যে পিকাডোর এবং যুক্তরাষ্ট্রে গ্রোভ আটলান্টিক উপন্যাসটি প্রকাশ করে। ২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি লেখাটি প্রকাশিত হয়।

উপন্যাসটি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা সাড়া ফেলে দেয়। ডগলাস স্টুয়ারটকে জেমস জয়েস, ডি এইচ লরেন্সের মতো লেখকদের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। কিছু প্রশংসার নমুনা-

বুকার বিচারক মণ্ডলী

‘আমরা প্রথম উপন্যাসেই বিমোহিত হয়ে গেছি। আসক্তি, সাহস এবং ভালোবাসার এক নিগূড় বর্ণনা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে আগে অসম, সংখ্যালঘু মানুষের প্রতি কী রকম বৈষম্য দেখা যেত, তার এক স্পষ্ট কথন। এটা খুবই কষ্টের। যা আমাদের পরিবারব্যবস্থাকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করে।’ 

বিথানি প্যাট্রিক, ওয়াশিংটন পোস্ট

‘প্রথম উপন্যাস, তবে পড়লে মনে হয় কালজয়ী।’

নিউইয়র্ক টাইমস বুক রিভিউ

‘শাগি বেইনের প্রতিটি পাতায় একটা জিনিস প্রকট- ব্যথা। এটাই শাগি ব্রেইনের বাস্তবতা। শাগি বেইন, আশির দশকে গ্লাসগোতে বড় হচ্ছে। তার রূপসী, ধ্বংসাত্মক মা অ্যাগনেস বেইন। তিনি মদ খেতে খেতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। এটা একটা আশ্চর্য বিষয়, এ অবস্থায়ও কত অদ্ভুতভাবে তারা বেঁচে আছে। লেখকের মনে এ পরিমাণ ভালোবাসা না থাকলে বইটি পড়া সম্ভব হতো না। ভালোবাসার ডগলাস স্টুয়ারট। তিনি আমাদের চরিত্রের কিছু খারাপ দিক দেখিয়েছেন, তবে খারাপ মানুষ দেখাননি। শুধু ক্ষতিটাই দেখিয়েছেন। প্রতিশোধ না। তার খারাপ পরিস্থিতিগুলো সম্পর্কে খুব অনন্য ধারণা, তবে ভালোবাসার প্রতি তার বিশ্বাস আরো বেশি। বইটি আমাদের এক অকুল পাথারে ফেলে দেয়। জীবন হয়তো সংক্ষিপ্ত, তবে তা পার করতে সারা জীবন লেগে যায়।’   

স্টুয়ারট বেশ আন্তরিকভাবেই তার প্রথম উপন্যাসটা লিখেছেন। কারণ, তিনি পেশাদার লেখক নন। লন্ডনের রয়েল কলেজ অব আর্ট থেকে পড়াশোনা করে তিনি ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়তে নিউইয়র্কে যান। তিনি দীর্ঘদিন থেকেই বানানা রিপাবলিক, কেভিন ক্লেইন, গ্যাপ এবং র‍্যালফ লরেনের মতো ফ্যাশন হাউসগুলোর সঙ্গে কাজ করছেন। বুকার পাওয়ার পর তিনি লেখালেখিকে পেশাদারভাবে নেয়ার আশা প্রকাশ করেন। সব সময় ‘পেশাদারিত্ব’ ভালো কি না- তা অবশ্য একটা প্রশ্ন।

বুকার জয়ের জন্য ডগলাস স্টুয়ারট ৫০ হাজার ইউরো পান।

সবমিলিয়ে অবশ্য একটা প্রশ্ন মাথায় আসে। ‘শাগি বেইন’ যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষাপটে তৈরি, তা খুব একটা সুখকর নয়। তবে, সে সময় লন্ডনকেন্দ্রিক অনেক লেখকই মার্গারেট থ্যাচারের পদক্ষেপগুলোকে সমর্থন করেন। কারণ, এ পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে ক্যাপিটালিজম উপকৃত হয়। তবে, তা শ্রমজীবী সমাজের জন্য খুব একটা ভালো অভিজ্ঞতা ছিল না। সে পরিস্থিতির পৃথিবীব্যাপী বর্তমান অবস্থা আরো খারাপ। সাহিত্য হিসেবে ‘শাগি বেইন’ তখনি সফল হবে- যদি মানুষ হিসেবে আমরা আরো সহানুভূতিশীল হই এবং সমাজের সকলের অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা করি- কোনো পুরস্কার পাওয়ায় নয়। নাহলে আমাদের পরিণতিও অ্যাগ্নেস বেইনের মতোই হবে- বাইরে সাফল্য, ভেতরে হাহাকার।

(বিদেশী পত্রিকা অবলম্বনে)