ভারতকে ভ্যাক্সিন রফতানি এখন পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে, আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

আগামী মাসের শুরু থেকেই ভারত ১৮ বছরের বেশি বয়সী সবাইকে কোভিডের টিকা দেবে, এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর দেশটিকে ভ্যাক্সিন রফতানি পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মাসতিনেক আগে ভারতে করোনার টিকা অভিযান শুরু হয়েছে, কিন্তু এর মধ্যেই সে দেশে টিকা উৎপাদন প্রচন্ড চাপের মুখে পড়েছে এবং টিকার অভাবে বহু ভ্যাক্সিনেশন সেন্টার বন্ধও করে দিতে হয়েছে।

ভারতকে ভ্যাক্সিন রফতানি এখন পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে, আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের
ফাইল ছবি

আগামী মাসের শুরু থেকেই ভারত ১৮ বছরের বেশি বয়সী সবাইকে কোভিডের টিকা দেবে, এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর দেশটিকে ভ্যাক্সিন রফতানি পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মাসতিনেক আগে ভারতে করোনার টিকা অভিযান শুরু হয়েছে, কিন্তু এর মধ্যেই সে দেশে টিকা উৎপাদন প্রচন্ড চাপের মুখে পড়েছে এবং টিকার অভাবে বহু ভ্যাক্সিনেশন সেন্টার বন্ধও করে দিতে হয়েছে।

এই পটভূমিতে একাধিক বিশেষজ্ঞ বিবিসিকে বলেছেন, দেশের সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে টিকা দেওয়ার অর্থ হল ভারতের 'ভ্যাক্সিন মৈত্রী' বা 'ভ্যাক্সিন কূটনীতি'র আপাতত এখানেই অবসান ঘটছে।

বাংলাদেশ-সহ যে সব দেশ শুধু ভারতে তৈরি টিকার অপেক্ষায় আছে, যথারীতি এই সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়বে সে সব দেশেও। কিন্তু আগামী ১লা মে থেকে সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের জন্যই ভ্যাক্সিনেশন উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে - যার অর্থ হল দেশের জনসংখ্যার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ বা ৯০ কোটির মতো মানুষকে সরকার এই অভিযানের আওতায় নিয়ে আসতে চাইছে।

কিন্তু এখন যে দুটি ভ্যাক্সিন এদেশে ব্যবহার করা হচ্ছে, অর্থাৎ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত ও পুনের সিরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি কোভিশিল্ড এবং ভারত বায়োটেকের তৈরি কোভ্যাক্সিন, তা দিয়ে এই বিপুল চাহিদা মেটানো কার্যত অসম্ভব। সে কারণেই এখন ভারত রাশিয়ার উদ্ভাবিত স্পুটনিক ভি কিংবা আরও নানা বিদেশি ভ্যাক্সিনকেও ছাড়পত্র দিচ্ছে।

তবে এই মুহুর্তে সফল একটা অভিযান চালাতে হলে ভ্যাক্সিনেশনের গতি আরও অনেক বাড়াতে হবে বলে মনে করেন রয়্যাল সোসাইটির ফেলো ও ভারতের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী গগনদীপ কাং।

ড: কাং বিবিসিকে বলছিলেন, "এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমরা কিন্তু দেশের জনসংখ্যার মাত্র সাত শতাংশকে অন্তত এক ডোজ ভ্যাক্সিন দিতে পেরেছি। আর দুটো ডোজই পেয়েছেন এক শতাংশের কিছু বেশি লোক।"

 "ফলে এখনও আমাদের অনেক রাস্তা যাওয়ার বাকি।"

"এই মুহুর্তে রোজ আমরা ৩০ লক্ষ বা তার কিছু বেশি ডোজ ভ্যাক্সিন দিচ্ছি। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে এটা দু-তিনগুণ বাড়ানো দরকার, রোজ অন্তত এক কোটি ডোজ দিতে পারলে খুব ভালো হয়।"

এই লক্ষ্যের ধারেকাছে পৌঁছতে গেলেও যে ভারতকে বিদেশে টিকা রফতানি পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে, তা নিয়েও গগনদীপ কাংয়ের বিশেষ সংশয় নেই। এমনিতেই অবশ্য গত মাস থেকে ভারত বিদেশে ভ্যাকসিন পাঠানো বন্ধ রেখেছে, তবে সরকার সেই সঙ্গেই দাবি করেছে ওই পদক্ষেপ 'সাময়িক'।

কিন্তু দিল্লিতে জহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ ধর বিবিসিকে বলছিলেন, অদূর ভবিষ্যতে ভারত থেকে আর কোনও ভ্যাক্সিন রফতানির সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না।

তার কথায়, "রফতানি যে এখন আর সম্ভব নয় সেটা কিন্তু স্পষ্ট। এই মুহুর্তে ভারতে যে চাহিদা সেটাই সামাল দেওয়া যাচ্ছে না, এর ওপর এলিজিবিলিটি ক্রাইটেরিয়া আরও শিথিল করা হলে টিকার ঘাটতি অনেকটাই বেড়ে যাবে।"

  "ফলে যে ভ্যাক্সিন কূটনীতিটা ভারত শুরু করেছিল, তা আর এখন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।"

"আর বিদেশে ভ্যাক্সিন পাঠিয়ে, কিংবা উপহার দিয়ে যে গুডউইল বা ভাবমূর্তিটা ভারত তখন অর্জন করেছিল, সেটাও কিন্তু এখন হুমকির মুখে।"

"একটা ইল-কনসিভড বা অপরিকল্পিত চিন্তাভাবনার ভিত্তিতে আমরা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম সেটাও এখন স্পষ্ট। ফলে ভারতের ওপর কতটা নির্ভর করা যায়, সেই বিষয়টাও কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ হবে", বলছিলেন বিশ্বজিৎ ধর।

কিন্তু জানুয়ারিতে এত ঢাকঢোল পিটিয়ে ভারতে যে ভ্যাক্সিন মৈত্রী অভিযান শুরু করেছিল, তা এত দ্রুত এভাবে থমকে যাওয়ার পেছনে কারণ কী? অধ্যাপক ধরের মতে, বিশ্বের বৃহত্তম টিকা উৎপাদক সিরাম ইনস্টিটিউটের সামর্থ্য ঠিক কতটা, তা নিয়ে হিসেবে অবশ্যই ভুলচুক হয়েছিল।

তার কথায়, "সিরাম ইনস্টিটিউট গোড়াতে বলেছিল তারা প্রতি মাসে দশ কোটি ডোজ উৎপাদন করতে পারবে। কিন্তু এখন তারা বুঝতে পারছে সেটা সম্ভব হচ্ছে না।"

 "তারা অবশ্য সেই সঙ্গেই বলছে যে মার্কিন প্রশাসন ডিফেন্স প্রোডাকশন অ্যাক্ট প্রয়োগ করে ভ্যাক্সিন কালচার বা নানা কাঁচামালের রফতানি আটকে দিয়েছে এবং টিকার সব উপাদান যথেষ্ট পরিমাণে আসছে না।"

"কারণগুলো যাই হোক, সিরামের উৎপাদন সামর্থ্য যে অনেক অনেক বাড়িয়ে হিসেব করা হয়েছিল সেটা কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে।"

 "সোজা কথায়, মাসে তাদের দশ কোটি ডোজ উৎপাদনের ক্ষমতা নেই। এখন ওরা বলছে ক্যাপাসিটি বাড়ানোর পরে হয়তো ওই পরিমাণ উৎপাদন করা সম্ভব - কিন্তু সেটা জুলাইয়ের আগে নয়!"

ফলে সিরাম ইনস্টিটিউট যে সব দেশের সঙ্গে টিকা সরবরাহের সমঝোতা করেছে, তাদের অপেক্ষা যে আরও দীর্ঘায়িত হতে যাচ্ছে তা বলাই বাহুল্য।

ভারতে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, আগস্ট বা সেপ্টেম্বরের আগে ভারত বিদেশে এক ডোজ টিকাও রফতানি করতে পারবে না।

সূত্র: বিবিসি বাংলা