‘তরকারি লইয়া বইয়া আছি কাস্টমার নাই’

করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মানুষের জীবিকার উপর যে কি পরিমাণ প্রভাব ফেলেছে তা আর কেউ না বুঝলেও জসিম মিয়া হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ফুটপাথে সবজি বিক্রি করেন জসিম উদ্দিন। সরকারে সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণার পর রাজধানীতে জনসমাগম অনেকটাই কমে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে জসিম মিয়ার ব্যবসায়ও।

‘তরকারি লইয়া বইয়া আছি কাস্টমার নাই’

নভেল করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মানুষের জীবিকার উপর যে কি পরিমাণ প্রভাব ফেলেছে তা আর কেউ না বুঝলেও জসিম মিয়া হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ফুটপাতে সবজি বিক্রি করেন জসিম উদ্দিন। সরকারে সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণার পর রাজধানীতে জনসমাগম অনেকটাই কমে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে জসিম মিয়ার ব্যবসায়ও।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বাংলাদেশে শুরু হয় গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে। এসময় হঠাৎ করেই আশংকাজনক হারে বাড়তে থাকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। বাড়তে থাকে মৃত্যু সংখ্যাও। এর প্রেক্ষিতে সরকার করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউন ঘোষণা করে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের উদাসীনতা থাকায় করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যু হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। ফলে সরকার সংক্রমণ প্রতিরোধে বাধ্য হয়ে গত ১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করে।

চলমান সর্বাত্মক লকডাউনের ফলে অনেকেই অজানা আতংকে রাজধানী ঢাকা ছাড়ে। মহানগরীতেও ঘরের বাইরে বের হওয়া আটকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বেশ তৎপরতা চালায়। ফলে মানুষের বাইরে বের হওয়ার প্রবনতা অনেকটাই কমে যায়। তবে এতে বিপাকে পড়ে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। বিশেষ করে যাদের প্রতিদিনের উপার্জনের উপর ভিত্তি করে সংসার চলে তারা পড়েন চরম সংকটে।

এমন ‘দিন এনে দিন খাওয়া’ মানুষের একজন জসিম উদ্দিন। মোহাম্মদপুর বেড়িবাধ থেকে ধানমণ্ডির দিকে যেতে পথে দেখা হয়ে যায় জসিমের সাথে। ফুটপাথে সবজির পসরা সাজিয়ে অলস বসে আছেন। আশেপাশে বিক্রেতার কোন চিহ্ন নেই। দাড়িয়ে ব্যবসা কেমন যাচ্ছে জিজ্ঞাসা করায় মৃদু হেসে জসিমের উত্তর, ‘তরকারি লইয়া বইয়া আছি কাস্টমার নাই।’ তবে জসিমের মুখে হাসি থাকলেও মনে যে তার শান্তি নেই তা তার মলিন হাসিতে বেশ স্পষ্ট ফুটে ওঠে।

জসিমের দোকানে খানিক সময় দাড়িয়ে আলাপ পাড়তেই জসিম তার জীবনের গল্প শুরু করে দেয়। পটুয়াখালী থেকে ১০ বছর আগে রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে এসে ওঠেন জীবিকার তাগিদে। শহরে গলিতে গলিতে ফেরি করে সবজির ব্যবসা শুরু করেন। গত ৪ বছর ধরে ফুটপাথে সবজি বিক্রি শুরু করেন। দুই ছেলে ও স্ত্রীর নিয়ে ৪ জনের সংসার বেশ কেটে যাচ্ছিল। তবে করোনা এসে পুরো জীবন অসহনীয় করে তুলেছে।

জসিম জানায়, ৮ বছর ও ৬ বছরের দুই সন্তান নিয়ে তাদের স্বামী-স্ত্রীর বেশ ভালোই দিন কেটে যেত। ঢাকায় সংসার চালিয়ে ও গ্রামে বৃদ্ধ বাবা-মাকে টাকা পাঠিয়ে কিছু টাকা জমিয়েও রাখতেন জসিম। তবে গত বছর করোনা এসে সব ওলট-পালট করে দিলো। জমানো টাকা শেষ হবার পর আধপেট খেয়ে না খেয়ে যখন আবার ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করছে তখনই আবার লকডাউন। এদিকে বাসা ভাড়া, সংসার খরচ, বড় ছেলের পড়ালেখার খরচ এই সব মিলিয়ে সময় যত যাচ্ছে তার দুশ্চিন্তাও বাড়ছে।

সরকারের বেধে দেওয়া সময়ে বাজারের সামনে ফুটপাথে দোকান নিয়ে বসে জসিম। কিন্তু কোন ক্রেতা নাই। এভাবে চলতে থাকলে ঢাকা শহরে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে যাবে বলে আক্ষেপ করে জানায় জসিম।

জসিমের মতই অবস্থা মোহাম্মদপুর টাউন হলের সামনে তালা-চাবি মেরামতের দোকানের মিলন হাওলাদারের। জানায় সাধারণ সময়ে প্রতিদিন গড়ে ছয়শো থেকে সাতশো টাকা উপার্জন করতেন মিলন। তা দিয়ে ঢাকায় থাকতেন আর গ্রামে পরিবারের কাছে টাকাও পাঠাতেন। তবে করোনা এসে সব কিছুই শেষ করে দিয়েছে। মিলন জানায় লকডাউন আসার পর আর দোকান খুলতে দেয় না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আগে মাঝে মাঝে কাস্টমাররা তার ফোন নম্বর নিয়ে যেত। তাদের বাসায় তালা বা চাবি মেরামতের কোন কাজ থাকলে ফোন দিয়ে ডেকে নিতো। তাতেও বেশ ভালো উপার্জন হতো। তবে করোনার কারণে এখন সেই রাস্তাও বন্ধ। এখন অলস সময় পার করে আর মাঝে মাঝে টাউন হল এসে দোকান পাহারা দিয়ে মিলনের সময় কাটে।

মিলন জানায়, ঢাকায় সে একা থাকার কারনে, এখনও টিকে আছেন। পরিবার থাকলে এতদিনে, বাড়ি চলে যেতে হতো। এসময় তাদের মতো এমন খেটে খাওয়া মানুষের কথা চিন্তা না করে সরকারের এমন লকডাউন ঘোষণার সমালোচনা করেন। মিলন বলেন, ‘যাদের অবস্থা ভালো তারা না হয় জমানো টাকা করচ করে চলতে পারবে। কিন্তু আমাদের মত যারা গরীব তাদের কি হবে।’