এক জীবনে বৈচিত্রময় কবরী

চট্টগ্রামের ১৩ বছরের কিশোরী ‘মিনা পাল’। সুভাষ দত্তের ‘সুতারং’ ছবির মধ্যে দিয়ে ১৯৬৩ সালে আবির্ভাব হলেন ‘কবরী’ নামে। পরিচিত পেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মিষ্টি মেয়ে’ হিসেবে। অভিনয়ের দুর্তি ছড়িয়ে ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন একজন কিংবদন্তি।

এক জীবনে বৈচিত্রময় কবরী

সময়টা পাকিস্তানী শাসকদের। সে সময় চট্টগ্রামের ১৩ বছরের কিশোরী ‘মিনা পাল’। সুভাষ দত্তের ‘সুতারং’ ছবির মধ্যে দিয়ে ১৯৬৩ সালে আবির্ভাব হলেন ‘কবরী’ নামে। পরিচিত পেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মিষ্টি মেয়ে’ হিসেবে। অভিনয়ের দ্যুতি ছড়িয়ে ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন একজন কিংবদন্তি।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টা ২০ মিনিটে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে চিরবিদায় নিলেন তিনি। মৃত্যুর আগে মুক্তিযুদ্ধ, চলচ্চিত্র, রাজনীতি, সমাজসেবাসহ সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন বাংলার এই লাস্যময়ী।

৭১ বছর বয়সী এ অভিনেত্রীর সাত দশকের জীবনটা যেন আশ্চর্য্য সফলতার গল্প। তবে সফলতার পাশাপাশি বিচ্ছেদের সুরও ছিলো বাংলা চলচ্চিত্রের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের বৈচিত্রময় জীবনে।

চলুন দেখে নেই প্রয়াত সারাহ বেগম কবরীর জীবনের এগিয়ে যাওয়ার এক টুকরো গল্প।

১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে জন্ম নেওয়া মিনা পালের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজারে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে নির্মাতা সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রে অভিষেকের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন কবরী।

সুতরাংয়ের সেটে প্রথম শটেই চড় খেয়ে কেঁদে ভাসানো সেই মেয়েটিরই ‘ময়নামতি’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘সারেং বৌ’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘সুজন সখী’র মতো ছবিগুলোতে অভিনয়গুণ দর্শকরা দেখেছেন অবাক বিস্ময়ে। ঢাকাই ছবির ইতিহাসে পেয়েছেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা।

অভিনয়গুণের দ্যুতি ছড়িয়েছেন ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ’, ‘পরিচয়’, ‘অধিকার’, ‘বেঈমান’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘সোনালী আকাশ’, ‘অনির্বাণ’, ‘দীপ নেভে নাই’, ‘রংবাজ’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘দীপ নেভে নাই’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’ এর মতো জনপ্রিয় ছবিগুলোতে। সিনেমায় পর্দা মাতানো কবরীর ভাষায়, “জীবন হচ্ছে একটি চলচ্চিত্র। জীবন কিন্তু স্থিরচিত্র নয়।”

১৯৭৫ সালে নায়ক ফারুকের সঙ্গে ‘সুজন সখী' ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর কবরীকে আর পেছনে ফিরে দেখতে হয়নি। এই সিনেমা দিয়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে যান তিনি। পরবর্তীতে তিনি রাজ্জাক, সোহেল রানা, ফারুক, উজ্জ্বল, জাফর ইকবালের মত অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন।

ষাট আর সত্তরের দশকের অনেক তরুণের ‘স্বপ্ন’ কবরীর স্বপ্ন কী ছিল? বালিকাবেলায় কবরী ভেবেছিলেন- বড় হয়ে সাদা শাড়ি পরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে ‘মাস্টারি’ করবেন। কিন্তু ‘লাইট-অ্যাকশন-কাটের’ আলো ঝলমলে জীবন তাকে নিয়ে যায় তারকালোকে।

তারুণ্যের সেই দিনগুলোতেই এল বাঙালির ইতিহাস বদলে দেওয়া মহান মুক্তিযুদ্ধ ‘একাত্তর’। অভিনেত্রী কবরী কলকাতায় গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেখানে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেন। পরে দেশে ফিরে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন সিনেমায়।

সেলুলয়েডের সেই রঙিন জীবন শেষে কবরীর পরের জীবন-চলচ্চিত্রও কম বর্ণময় ছিল না। একটা সময় অভিনয় শেষে নাম লেখান চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনায়। আসেন রাজনীতিতেও।

২০০৬ সালে তার পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘আয়না’ মুক্তি পায়। সর্বশেষ তিনি দ্বিতীয় সিনেমা ‘এই তুমি সেই তুমি’ নির্মাণ করছিলেন। তবে সেই ছবির কাজ আর শেষ করে যেতে পারেননি।

২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন কবরী। তবে রাজনীতিতে নেমে জীবনের আরেক চলচ্চিত্রের মুখোমুখি  হতে হয়েছিল বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে তাকে । এক সময় নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের বধূ কবরীকে ভোটের মাঠে সেই নারায়ণগঞ্জেই নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল।

২০১৭ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘স্মৃতিটুকু থাক’।

কবরী প্রথম বিয়ে করেন চিত্ত চৌধুরীকে। সেখানে বিচ্ছেদের পর ১৯৭৮ সালে তিনি বিয়ে করেন সফিউদ্দীন সরোয়ারকে। ২০০৮ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কবরী পাঁচ সন্তানের জননী।