ভুয়া বাদীর মামলায় আসামীর এক সপ্তাহ হাজতবাস

মামলার বাদী ভুয়া। সাক্ষী ও বাদীর ঠিকানাও ভুয়া। এমনকি মামলা দায়ের করতে বাদীর নোটারীও জাল। উপরুন্তু মামলায় আসামীর নাম ও ঠিকানা সঠিক।

ভুয়া বাদীর মামলায় আসামীর এক সপ্তাহ হাজতবাস

মামলার বাদী ভুয়া। সাক্ষী ও বাদীর ঠিকানাও ভুয়া। এমনকি মামলা দায়ের করতে বাদীর নোটারীও জাল। উপরুন্তু মামলায় আসামীর নাম ও ঠিকানা সঠিক। মামলা দায়েরের পর আদালত মামলাটি তদন্ত করতে না দিয়ে আসামীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করে। এরপর পুলিশ ওই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেয়ে আসামীকে গ্রেপ্তার করতে তার ঠিকানায় যায়। আসামীর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল করতে পুলিশ আসামীকে গ্রেপ্তার করে। এরপর আসামীকে আদালতে হাজির করা হলে তার রিমান্ড অথবা জামিনের শুনানির দিন বার বার পরিবর্তন হতে থাকে। এ অবস্থায় কয়েকবার জামিনের শুনানির দিন পরিবর্তন হওয়ার কারণে আসামীকে অন্তত ২০ থেকে ২৫ দিন কারাগারে হাজতবাস করতে হয়। পরবর্তীতে আসামী জামিন পাওয়ার পর আদালত বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে পায় যে মামলার সবটুকুই ভুয়া এবং আসামীকে হয়রানি করার জন্য একটি চক্র ওই মামলা দায়ের করেছিল।

এ ধরনের একটি প্রতারক চক্র রয়েছে যারা আদালতে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা সাজিয়ে হয়রানি করছে। এসব কথিত মামলার বাদী ভাড়াটে নারী-পুরুষ। আসামি চেনেন না বাদীকে। বাদী চেনেন না আসামিকে। এসব গায়েবি মামলাবাজ সিন্ডিকেটের নির্যাতনে অতিষ্ট হয়েছেন শত শত ভুক্তভোগী।

গত ৭ অক্টোবর ঢাকার মূখ্য মহানগর হাকিম আদালতে দায়ের করা সিআর মামলা নং-৪৪০/২০২০ তে বাদীর ঠিকানা বলা হয়েছে জাকির হোসেন, বাসা নং-৫২/ক/১, ফ্ল্যাট-এ-২, রোড ৮/এ, ধানমন্ডি, ঢাকা। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে আসামী সৈয়দ রফিকুল ইসলাম দিলু’র বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। আসামীর উল্লেখিত ঠিকানা সংশ্লিষ্ট তেজগাঁও থানায় পাঠানো হয়। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেয়ে পুলিশ ১৩ অক্টোবর রাতে মনিপুরীপাড়ার ১৪৭/সি নম্বর বাড়ি থেকে আসামীকে গ্রেপ্তার করে পরদিন আদালতে পাঠায়।

আদালত তার জামিনের শুনানির সময় বাদীকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। বাদী হাজির হতে পারেননি বলে পরদিন ১৫ অক্টোবর পুনরায় জামিনের শুনানির দিন ধার্য করে আদালত। এদিনও জামিনের শুনানির সময় মামলার বাদীকে হাজির করতে পারেননি বাদীর আইনজীবী। পরবর্তীতে আসামীর জামিনের শুনানির দিন ধার্য করে ১৯ অক্টোবর। ওই দিনও বাদীকে হাজির করতে পারেনি বলে আদালত আসামীকে জামিন দেয়। জামিন পাওয়ার পর ওই মামলায় আসামী পুনরায় আদালতে হাজির হয়ে মামলার বাদী ও সাক্ষীদের দেখতে চায়।

আদালত বিষয়টি তদন্ত করে মামলার বাদী জাকির হোসেনকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু বাদী জাকির হোসেনের পক্ষে ওকালনামায় স্বাক্ষর করা আইনজীবী খালিদ হোসেন আদালতকে জানান যে, মামলার বাদী জাকির হোসেনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তখন আদালত মামলার বাদীর ঠিকানা যাচাই-বাছাই করার নির্দেশ দেয় ধানমন্ডি থানা পুলিশকে।

ধানমন্ডি থানার এএসআই মোখলেসুর রহমান জানান, গত ১১ মার্চ মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট মো: মইনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত আদেশনামা ধানমন্ডি থানা পুলিশের কাছে আসে।  আদেশনামায় মামলায় উল্লেখিত ধানমন্ডির ৮/এ নম্বর রোডের ৫২/ক/১ নম্বর ভবনের এ-২ নম্বর ফ্ল্যাট বাদী জাকির হোসেনের ঠিকানা কিনা তা যাচাই করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি তদন্ত করে আদালতের কাছে রিপোর্ট দেন।

তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করেন, সরেজমিন দেখতে পান যে ধানমন্ডির ৮/এ নম্বর রোডের ৫২/ক/১ নম্বরের কোনো বাড়ি নেই। রোড নং-৮/এ তে ৫২/১ নম্বর বাড়ি আছে। ওই বাড়িতেও জাকির হোসেন নামে কেউই কোনদিন বসবাস করেননি।

এ ব্যাপারে ওই মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী খালিদ হোসেন বলেন, আসলে কেউ যদি তার জাতীয় পরিচয়পত্র ও অন্যান্য তথ্য নিয়ে একজন আইনজীবীর কাছে আসেন, আমরা মামলা দায়েরে সহায়তা করি। এ ব্যাপারে মামলার বাদী জাল জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করেন কিনা-তা নিশ্চিত হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। আমার বাদী সব ঠিকানা ও অভিযোগ আদালতে উত্থাপন করি। আদালত সেটিকে মামলা হিসেবে গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তদন্ত করতে গিয়ে বাদীর অনেক তথ্যই ভুল হলে, আমরা আইনজীবী তো সেটার দায়ভার নিব না।

দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলা করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেউ যদি তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা আদালতে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারেন তাহলে বাদির বিরুদ্ধে ওই ধারায় মামলা করা যায়। আর ফৌজদারি কার্যবিধি ২৫০ ধারা অনুযায়ি মিথ্যা মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন আদালত। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা আমলযোগ্য নয় এ রকম কোনো মামলায় মিথ্যা প্রতিবেদন দিলে তার বিরুদ্ধেও এ ধারা অনুযায়ি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন আদালত। মিথ্যা মামলা ছাড়াও দণ্ডবিধির ১৯৩, ১৯৪ এবং ১৯৫ ধারায় বলা বলা আছে মিথ্যা সাক্ষ্যের মাধ্যমে মিথ্যা মামলায় সহায়তা অপরাধ। এই অপরাধে ৭ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান আছে। যদি এমন একটি মিথ্যা মামলা করা হয় যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড তাহলে এই মিথ্যা মামলার শাস্তি ১০ বছরের কারাদন্ড। ঢাকার আদালতের একজন আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, মিথ্যা মামলা হলে আসামী বাদীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন। কিন্তু যে মামলার বাদীর কোন অস্তিত্ব নাই, বাদী ভুয়া- সেই মামলার আসামী কার বিরুদ্ধে মামলা করবেন? দন্ডবিধিতে এ সংক্রান্ত আসামীর হয়রানির ক্ষতিপুরুণের কোনো সুযোগ নেই। বরং আসামী তার হয়রানির বিচার চেয়ে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন।

এ ব্যাপারে ঢাকার আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আবু বলেন, এই মিথ্যা মামলা থেকে আগে ভিকটিমকে অব্যাহতি দিতে হবে। এরপর আদলত তদন্ত করে দেখবে এই মিথ্যা মামলা দায়েরকারী চক্রটি কারা। মামলা দায়েরের সময় উচিত ছিল বাদীর জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নেওয়া। এগুলোর কিছুই করা হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, এই ধরনের মিথ্যা মামলা দায়েরে ভিকটিমকে আইনি সহায়তা দিতে হবে। ভিকটিম কার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবে-সেটা ঠিক করা উচিত।

প্রকৌশল নিউজ/এমআরএস