সিন্দুরমতির পুকুর ঐতিহ্যের স্বাক্ষী 


আল্লামা ইকবাল অনিক
সিন্দুরমতির পুকুর ঐতিহ্যের স্বাক্ষী 
  • Font increase
  • Font Decrease

আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগের কথা। তখন মিসরে ফেরাউনি সভ্যতার চরম বিকাশ ঘটেছিল। সমসাময়িককালে বর্তমান শ্রীলংকা থেকে একজন ধর্মপ্রাণ ব্রাক্ষণ জমিদার নদীপথে সিন্দুরমতি এলাকায় আগমন করেন। তখন এ এলাকার ভুপ্রকৃতিগত অবস্থান সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। সিন্দুরমতি পর্যন্ত এলাকাটি সমূদ্র-তীরবর্তী ছিল। ব্রাক্ষণ জমিদার তার পাইক পেয়াদা সহ জাহাজ নোঙ্গর করেন সেখানে। সিন্দুরমতি গ্রামে তিনি বসতি স্থাপন করে জমিদারি গড়ে তোলেন। প্রজাবদের মঙ্গলের জন্য তিনি সদা সচেষ্ট ছিলেন। তার সৈন্যসামন্ত ও রাজকর্মকর্তাসহ মন্ত্রীগণও ছিলেন তার যোগ্য অনুসারি। ধর্মপ্রাণ ও ব্রাক্ষণ রাজা নিঃসন্তান ছিলেন। অনেক পূজা-অচর্না ও প্রার্থনার ফলস্বরুপ ভগবান দয়াপরবশ হয়ে তার ঘরে পর পর দুটি কন্যা সন্তান দান করেন। সারা রাজ্যের প্রজাকূল খুশিতে দিনাতিপাত করছিল। রাজা বড় মেয়ের নাম রাখলেন সিন্দুর আর ছোট মেয়ের নাম মতি।

কন্যাদ্বয়ের শিশুকালে রাজ্যের চারিদিকে ভয়াবহ খরা দ্যাখা দেয়। চারিদিকে শুধু লোনা পানি থাকায় প্রজাকূল পানীয় জলের দারূণ অভাবে পতিত হয়। রাজা এই সমস্যা সমাধানের জন্য দিন-রাত প্রার্থনা করতে থাকেন। অবশেষে ভগবান তার প্রতি সদয় হন। স্বপ্নযোগে রাজাকে পুকুর খননের নির্দেশ দ্যান। স্বর্গীয় আদেশ প্রাপ্তির পর প্রজাবৎসল রাজা তার সৈন্যসামন্ত ও প্রজাকুলকে পুকুর খননে নিয়োগ করেন। কিছুদিনের মধ্যে পুকুর খনন করা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু সে পুকুরে কোন পানি পাওয়া যায়নি। দিশেহারা হয়ে রাজা আবার ভগবানের নিকট প্রার্থনা শুরু করেন।

প্রাজাবৎসল রাজার প্রার্থনা সন্তুষ্ট ভগবান স্বপ্নযোগে পানি প্রাপ্তির উপায় জানিয়ে দ্যান। সে মোতাবেক রাজা একটি কালো ও সাদা পাঠা,একটি কালো এবং সাদা সিন্দুক আর পুজার উপকণ এবং দুই কন্যাকে নিয়ে পুকুরের গভীর তলদেশে পুজা-অর্চনা শুরু করেন। কিন্তু পুকুরে জল আসে না। হঠাৎ করে রাজার মনে পড়ে যায় যে, পুজার কিছু উপকরণ রাজপ্রসাদে রেখে এসেছেন। রাজা রেখে আসা উপকরণ আনতে রাজপ্রসাদে চলে যায়। অল্প সময়ের মধ্যে ফিরে এসে দেখেন পুকুরের কানায় কানায় পানিতে ভরে যায়। কিছু পুজার উপকরণ ভেসে উঠলেও তার দুই কন্যা ভেসে উঠেনি। এভাবে রাজা-রাণীর প্রাণপ্রিয় দু’কন্যার জীবনের বিনিময়ে স্বপ্নের পুকুরে পানির আবির্ভাব ঘটে। প্রজাকুলের পানির সমস্যা সমাধান হয়। অসুস্থ লোকের এই পানি পান করে সুস্থ হতে থাকে। কিন্তু রাজা-রানীর মন কন্যা হারানোর শোকে মুহ্যমান হয়ে জায়। শোকে কাতর রাজা-রাণী পুনরায় নিঃসন্তান হওয়ার জালায় ভুগতে থাকেন। তারা আবার পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে ভগবানের নিকট পুজা-অচর্না করে তাতে প্রজাকূলও যোগ দ্যান।

কয়েকদিন অতিবাহিত হতে না হতে ভগবান স্বপ্নযোগে রাজাকে জানান যে,তার দু’কন্যার মৃত্যু হয়নি। বরং তার ওই পুকুরের পানির নিচে স্বর্গীয় ভাবে জীবনযাপন করছেন এবং চিরজ্ঞীবের মত বেড়ে উঠছে। ভগবানের নির্দেশক্রমে পরদি ভোরে পুকুর পাড়ে রাজার দু’কন্যা রাজাকে তাদের হাতের আঙুল ভাসিয়ে রাজাকে দর্শন দ্যায় এবং কয়হা বলে। রাজা তাদের ভাল থাকার কথা জানতে পেরে শোক ভুলে যায় এবং আর ধর্মপরায়ণ হয় আর প্রজাদের সেবায় মনোনিবেশ করে।

এর অনেকদিন পর,এক সন্ধ্যাবেলা;দিনের কাজ শেষে এক বাইন্ন্যা (স্বর্ণাকার) দিঘীর পাড় ধরে বাড়ি ফিরছিল। তাকে দেখে দুই বোন পানি থেকে উঠে স্বর্ণাকারের কাছে নোলক ও কানের দুল দেখতে চায়। পছন্দ হলে তারা সেগুলো নিতে চায়। স্বর্ণকার দাম চাইলে তারা কাগজের চিরকুটে লিখে তাকে বলে “আমার বাবার কাছে এটা নিয়ে গেলে তিনি আপনাকে এর দাম দিয়ে দিবেন।”

বিগত ১৯৭৫/৭৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রায় ১১ একর জমিতে অবস্থিত। পুকুরের প্রায় ছয় একর জলাভূমি।পুকুর একবার সংস্কার হয়েছিল। সংস্কার কাজে নিয়োজিত দিনমজুরগণ অসংখ্য পুরনো আমলের স্বর্ণমুদ্রা, রাম-লক্ষণের মুল্যবান ধাতব মুর্তি, রৌপ্যমুদ্রাসহ অনেক মুল্যবান জিনিস পায়। যার মুল্য প্রায় কোটি কোটি টাকা হতে পারে।এ পুকুরের বিশেষ বৈশিষ্ট হচ্ছে সারাবছর কানায় কানায় পানিপূর্ণ থাকে। ভরা বর্ষা ও খরায় এর কোন হেরফের হয়না। চৈত্র-বৈশাখ মাসে যখন চারিদিকের পুকুরের পানি শুকিয়ে যায় তখন এই পানি থাকে কানায় কানায় ভরা। এ সময় এ পুকুরের পানির উপরিতলের সাথে পার্শ্ববতী সমতল ভুমির প্রায় ২৫/৩০ উচ্চতার তারতম্য থাকে। হাজার বছর ধরে স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস যে, সিন্দুরমতি পুকুর ও ব্রহ্মপুত্র নদের মধ্যে ভুগভর্স্থ প্রায় ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি গুপ্ত সুড়ঙ্গ রয়েছে। ফলে এ পুকুরের পানির উচ্চতা সারা বছরব্যাপী একইরকম থেকে যায়। এটা একটি বিস্ময়কর ঘটনা।

এই পুকুরের অবস্থান লালমনিরহাট জেলার লালমনিরহাট সদর থানা এবং কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট থানা। রাজারহাট থানা থেকে এর অবস্থান ৪ কি.মি. এবং লালমনির সদর থানা থেকে এর অবস্থান ১৫ কি.মি.। এই পুকুর দুই থানার অন্তর্ভুক্ত। এই পুকুরের পাড়ে প্রতি বছর বিশাল মেলা বসে। হিন্ধু ধর্মালম্বিরা মেলার সময় পাপ মুক্তির জন্য স্নান করে। এই মেলা বসে বাংলা সনের ফাল্গুন-চৈএ মাসের মধ্যে। এই মেলায় বিভিন্ন ধর্মের লোক আসে এবং দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক আসে মেলা শুরুর আগে থেকে। এই মেলার বিশেষ গুণ হচ্ছে মেলায় প্রচুর পরিমান মাছ পাওয়া যায়।

লেখক: আল্লামা ইকবাল অনিক, স্টাফ রিপোর্টার, জিটিভি

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রকৌশলনিউজের এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)