উদ্যোগতা তৈরিতে ‘রাইস ট্রান্সপ্লান্টার’ : কৃষিতে বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ


ডেস্ক নিউজ
উদ্যোগতা তৈরিতে ‘রাইস ট্রান্সপ্লান্টার’ : কৃষিতে বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ
  • Font increase
  • Font Decrease

দেশে দ্রুত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে কৃষিখাতে শ্রমিক সংকট থাকে। দিন দিন এ সংকট প্রবল হচ্ছে। বিশেষত ধান রোপণ ও কাটার মৌসুমে শ্রমিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। শ্রমিক সংকট কমাতে ও কৃষিখাত বাঁচাতে সরকার কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের উদ্যোগ নেয়। সময় ও অর্থ সাশ্রয় করে কৃষকদের লাভবান করতে ধানের চারা রোপন করতে ‘রাইস ট্রান্সপ্লান্টার’ যন্ত্রটি সারাদেশে ‘ব্যাপক জনপ্রিয়’ হয়ে উঠেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সারাদেশে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের সহায়তায় উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের মাধ্যমে কৃষকদের চাষাবাদ করার জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়েছে। কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে এবং কৃষকদের উৎসাহিত করতে উপজেলা কৃষি অফিস রাইস ট্রান্সপ্লান্টারে ধানের চারা রোপণে সহায়তা ও পরামর্শ দিচ্ছে। এমনকি কৃষি কর্মকর্তারা সরেজমিনে ধান রোপণের পদ্ধতি প্রান্তিক কৃষকদের শেখাচ্ছেন।

কৃষি বিভাগ বলছে, মেশিনের মাধ্যমে ধান রোপণ ও মাড়াই হলে চাষিরা অধিক লাভবান হবে। ইতোমধ্যে সারাদেশে ‘রাইস ট্রান্সপ্লান্টার’ মেশিনের উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। সেই উদ্যোক্তারা কৃষি বিভাগের পরামর্শে কাজ করে লাভবান হচ্ছে। তেমনি একজন রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির কুমারেশ চন্দ্র মণ্ডলের স্ত্রী প্রমীলা মণ্ডল (৩৫)। ইতোমধ্যে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার মেশিন দিয়ে রোপা আমন ধানের চারা রোপণ করে এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।

কালাবিলা গ্রামের চার কন্যা সন্তানের জননী প্রমীলা মণ্ডল জানান, তার চারটি কন্যা সন্তান। সংসারে স্বামী ছাড়া আর কেউ নেই আয় করার মতো। অভাবের সংসারে পারিবারিক ঝামেলা লেগেই থাকত। ২০০৭ সাল থেকে সে স্বামীর সঙ্গে মাঠে কাজ করতে নেমে পড়ে। প্রথম দিকে মানুষ নানা ধরনের কটূক্তি করতো। তার স্বামীকে অপমান করতো। কিন্তু মানুষের কথায় তারা কান দেননি। এখন তার সংসারে অনেক শান্তি।

সংসার চালানোর পাশাপাশি কৃষি কাজ করেই সে ৩ কন্যার লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছেন। তাকে দেখে গ্রামের অনেক নারী সরাসরি কৃষি কাজে নেমে পড়েছে। সব নারীকে সে বিশেষ প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকেন। এরই মধ্যে সে সরকারি ভর্তুকি পেয়ে একটি রাইস ট্রান্সপ্লান্টার মেশিন কিনেছেন। নিজের জমির পাশাপাশি সে অন্যের জমিতেও ধান রোপণ করে দিয়ে আসেন এই আধুনিক মেশিনে। এতে করে তার সংসারের সচ্ছলতা ফেরানোর স্বপ্ন দেখছেন।

তিনি আরও জানান, কৃষি অফিসের সহযোগিতায় এলএসপি নেটওর্য়াক গড়ে তুলেছেন তারা। এখানে ২০ জন সদস্য রয়েছেন। তার মধ্যে নারীই ১৫ জন। এই নেটওর্য়াকের মাধ্যমে চলতি মৌসুমে ৫০ একর জমিতে ধানের চারা রোপণ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। ২২ শতাংশ জমিতে ধানের চারা রোপণ করতে তারা নিবেন ৮০০ টাকা। এসব নারীরা এলাকায় বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন।

ইতোমধ্যে ৪০ একর জমিতে ধান লাগিয়েছেন প্রমীলা মণ্ডল।

ওই এলাকার কয়েকজন কৃষক জানান, রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের মাধ্যমে ধানের চারা রোপণে কোন ধারণা না থাকলেও এ নিয়ে উপজেলা কৃষি বিভাগ প্রশিক্ষণ দিয়েছে। রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের মাধ্যমে চাষ করে শ্রমিক সাশ্রয়ী ও কম সময়ে বেশি ফলনে লাভবান হওয়া সম্ভব। বালিয়াকান্দির কৃষক আমজাদ হোসেন বলেন, ‘জমিতে ধানের চারা রোপণ করলে শ্রমিকের খরচ যদি ২ হাজার টাকা, সেখানে এই মেশিন দিয়ে ধান রোপণ করলে খরচ হবে ৩০০ টাকা। খরচ কম হওয়ায় আমি এই যন্ত্র দিয়েই ধান লাগিয়েছি।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) এর সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের পরিচালক তারিক মাহমুদ বলেন, শুধু প্রমীলা মণ্ডল নয়, সারাদেশের নারীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার বা ধানের চারা রোপণের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটবে। কম্বাইন্ড হারভেস্টর যন্ত্রটি জনপ্রিয় হলেও রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রটি জনপ্রিয় হয় নাই। আশা করা যায়, নারীদের হাত ধরে কম্বাইন্ড হারভেস্টরের মতো এটি একটি জনপ্রিয় যন্ত্রে পরিণিত হবে এবং নারীদের অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।

‘দেশে শ্রমিক সংকটের কারণে শ্রমিক পাওয়া যায় না। আর যন্ত্রটি দিয়ে ঘণ্টায় এক একর জমিতে ধানের চারা রোপণ করা যায়। এখানে এক বিঘা জমিতে এক হাজার টাকা লাভের মাধ্যমে তারা একজন উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠবে। সবচেয়ে বড় কথা; শুধুমাত্র কারো সদিচ্ছা থাকতে হয়। এই সদিচ্ছা থাকলেই আশা করা যাচ্ছে, আগামীতে নারীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়বে আর দেশে ভালো ভালো উদ্যোক্তা তৈরি হবে’ যোগ করেন তিনি।

ডিএই সূত্রে জানা গেছে, রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের মাধ্যমে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বিভিন্ন দূরত্বে ও গভীরতায় ধানের চারা রোপণ করা যায়। একজন শ্রমিক ঘণ্টায় প্রায় এক একর জমিতে চারা রোপণ করতে পারেন। যন্ত্রটি ব্যবহার করতে ঘণ্টায় মাত্র আধা লিটার পেট্রল প্রয়োজন হয়। ফলে জ্বালানি খরচও খুব কম। এছাড়া আছে নিয়ন্ত্রিত ও নিখুঁতভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণে চারা রোপণ করার সুবিধা। নেই চারা নষ্ট হওয়ার কোন আশঙ্কাও। যন্ত্রটি ব্যবহার করলে বীজতলা তৈরির জন্যও আলাদা জমির প্রয়োজন হয় না। বাড়ির উঠানেই বীজতলা তৈরি করা সম্ভব। বৃষ্টির মধ্যেও খুব সহজে চারা রোপণ করা যায়। অত্যন্ত কম খরচ, শ্রম ও সময়ে বেশি জমিতে চারা লাগানো সম্ভব হওয়ায় কৃষকরা যন্ত্রটির প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন।

বাংলাদেশে প্রায় ৬২ শতাংশ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন সেক্টরে, যার মধ্যে শস্য সেক্টরেই প্রায় ৫৫ শতাংশ। কৃষি আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জীবনীশক্তি। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪২ দশমিক ৬২ শতাংশ কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত। কৃষি অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দেশে মৌসুমের সময় কৃষি শ্রমিক পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ও কম্বাইন্ড হারভেস্টরসহ সব ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানোর বিকল্প নেই। এর মাধ্যমে কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমিয়ে ইতোমধ্যে টেকসই কৃষি ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে।

প্রকল্পের আওতায় কম্বাইন্ড হারভেস্টরসহ, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, সিডার ও রিপার মেশিনের ব্যবহারে আগ্রহ সৃষ্টি করছে। স্থানীয় পর্যায়ে ট্রান্সপ্লান্টার ব্যবহার উপযোগী ধানের চারা উৎপাদনে উদ্যোক্তা তৈরি সাহায্য করছে বলে জানা যায়।