কানের মধ্যে শোঁ শোঁ শব্দ বা টিনিটাস রোগে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা


প্রফেসর ডাঃ মোঃ আবু সালেহ আলমগীর
কানের মধ্যে  শোঁ শোঁ শব্দ বা টিনিটাস রোগে  ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা
  • Font increase
  • Font Decrease

কথার পাশাপাশি শোঁ শোঁ শব্দের বাড়তি যে আওয়াজ শোনা যায়, তাকে বলা হয় টিনিটাস (Tinnitus)। ল্যাটিন শব্দ ‘টিনিয়ার’ থেকে ইংরেজি শব্দটির উৎপত্তি, এর অর্থ হলো ঘণ্টার শব্দ।

নাক-কান-গলার বিভিন্ন রোগের সঙ্গে বা আলাদাভাবে কানে শিস দেওয়ার মতো আওয়াজ, কেটলিতে পানি বাষ্প হওয়ার আওয়াজ, ঘণ্টার মতো আওয়াজ, হিসহিস শব্দ বা রেল ইঞ্জিন চলার আওয়াজ, টেলিভিশনে সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেলে যেমন আওয়াজ হয়, ঠিক সে রকম আওয়াজ হলেই বুঝতে হবে যে, টিনিটাস রোগে আক্রান্ত হয়েছি।

বিভিন্ন কারণে এই টিনিটাস রোগে আক্রান্ত হতে পারে যে কেউ। এর মধ্যে কানের কোন রোগের কারণে যদি টিনিটাস হয়, তবে সেটা অল্প দিনের মধ্যে রোগী অনুভব করে। তবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থাৎ অনেক বছর ধরে যাদের কানে টিনিটাস আছে, তাদের শুধু কানের সংক্রমণ নয় বরং অন্য নানা রোগ থাকতে পারে।

কানের ভেতর টিউমার বা রক্তনালির অতি বৃদ্ধির কারণে এ রকম হতে পারে। অনেক সময় কানে সামান্য ময়লা বা খৈল জমেও টিনিটাস হতে পারে।

কানের কিছু রোগ, উচ্চমাত্রার শব্দ, বাজি-পটকার আওয়াজ, হেডফোন ব্যবহারের কারণে যে টিনিটাস হয়, সেটা সাধারণত একটানা হয়ে থাকে। রক্তনালি বা অন্যান্য টিউমারের কারণে হওয়া টিনিটাসে একধরনের স্পন্দন থাকে। ধূমপান বা মদ্যপান, বড় করে হাই তোলা, জোরে শব্দ করে হাঁচি দেওয়া, জোরে নাক ঝাড়া ইত্যাদিতে টিনিটাস বাড়ে। এ ছাড়া রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ, স্ট্রোকের চিকিৎসার কিছু কিছু ওষুধ, নানা রকম অ্যান্টিবায়োটিক, যক্ষ্মার ওষুধ ইত্যাদির কারণেও টিনিটাস হতে পারে।

অনেক সময় এটা কেবল বিশ্রামেই সেরে যায়। অনেক সময় কিছু আগে থেকে খেয়ে আসা ওষুধ বন্ধ করে দিলেও সেরে যায়। খাওয়া-দাওয়া ও স্বভাবগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে, যেমন চা-কফি, কোমল পানীয়, অ্যালকোহল, চকলেট ইত্যাদি এবং ধূমপান বন্ধ রাখা ভালো। প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন বি, জিংক, ম্যাগনেসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে এর প্রতিরোধে।

এ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়ার কারণে টিনিটাস হয়ে থাকলে সেটা বন্ধ রাখা, তার পরিবর্তে অন্য ওষুধ বাজারে থেকে থাকলে সেটা খাওয়া, রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত।

বয়সজনিত কারণে কানের সমস্যা, ইনজুরি অথবা সারকুলেটুরি সিস্টেম ডিসঅর্ডার এর করণেও কানে শোঁ শোঁ শব্দ বা  টিনেটাস হতে পারে। পৃথিবীতে প্রতি পাঁচজনের একজন টিনেটাসে রোগে ভুগে থাকেন। যদি কোন ব্যক্তি কানে ভোঁ ভোঁ, বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, ঘণ্টার ধ্বনি অনবরত শুনতে থাকে, তখন এ ধরণের কন্ডিশনকে বলা হয় টিনেটাস। যেসব জায়গায় শব্দ দূষণ বেশি সেখানকার লোকদের এ ধরনের সমস্যা বেশি দেখা যায়। টিনিটাসে নারীদের চেয়ে পুরুষরাই বেশি আক্রান্ত হন।

টিনিটাস রোগের  কারণ
টিনিটাস রোগের সমস্যা কানের মধ্যে হলেও, এর উৎপত্তিস্থল মস্তিষ্ক। আমাদের মস্তিষ্ক অনেক নার্ভ দিয়ে গঠিত। একেক নার্ভের কাজ একেক রকম। মস্তিষ্কের যে অংশ দিয়ে শব্দ প্রক্রিয়াজাত করা হয় সেই অংশের নাম হল অডুটরি করটেক্স। আর এই অংশের মধ্যে থাকে অষ্টম ক্রেনিয়াল নার্ভ ভেসটিবুলোকোকলিয়ার। এই নার্ভের সমস্যা হলে টিনেটাস হয়ে থাকে।

আবার অন্তঃকর্ণের কোষের সমস্যার কারণেও টিনিটাস হতে পারে। আমাদের কানের ভেতর ক্ষুদ্র লোম আছে যেগুলো শব্দ তরঙ্গের সঙ্গে নড়াচড়া করে। এই কোষগুলো এক ধরণের ইলেকট্রিকাল সিগন্যাল অষ্টম ক্রেনিয়াল নার্ভের মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্কে পাঠায়। মস্তিষ্ক এই সিগন্যালের প্রতিক্রিয়া রূপে সিগন্যাল পাঠায়। এজন্য আমরা শব্দ শুনতে পাই। যদি এই লোমগুলো ছিঁড়ে যায় বা সঠিকভাবে কাজ না করে, তখন মস্তিষ্কে অনিয়মিত এবং ভুল ইলেকট্রিকাল ইমপালস পৌঁছায় যার ফলে টিনিটাস আক্রান্ত ব্যক্তি কানে অ্যাবনরমাল শব্দ যেমন- ভোঁ ভোঁ, ঝিঁ ঝিঁ, শোঁ শোঁ, ঘণ্টার ধ্বনি শুনতে পায়। এছাড়াও উচ্চ শব্দ স্বর, কানে ময়লা জমা হলে এবং কানের মধ্যে এবনরমাল হাড় বেড়ে গেলেও টিনেটাস হতে পারে।

কারা টিনিটাস রোগের ঝুঁকিতে
বয়স ৫০ এর বেমি হলে,  অসহনীয় উচ্চ শব্দ স্বর, ধূমপান, কার্ডিও ভাসকুলার সমস্যায় যারা আক্রান্ত থাকে তাদের এ ধরনের সমস্যা হয়। 

টিনিটাস রোগের  লক্ষণ
অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করা, মানসিক চাপে থাকা, ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়া, মনোযোগে বিঘ্ন, বিষন্নতা, উদ্বেগ এবং বিরক্তি প্রকাশ।

টিনিটাস রোগের  চিকিৎসা
টিনিটাস রোগে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা অত্যন্ত কার্যকর। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে টিনিটাস থেকে পুরোপুরি সুস্থ হওয়া যায়। ফিজিওথেরাপিউটিক এক্সারসাইজ মধ্যে রয়েছে- দুই হাত দিয়ে কানের পেছন থেকে সামনের অংশে ৭০ থেকে ৭৫ বার ঘষতে হবে। বৃদ্ধাঙ্গুল সোজা রেখে কানের ভেতরে ও বাইরে নিতে হবে। ৭০-৭৫ বার এই ব্যায়ামটি করতে হবে।

টিনিটাস রোগের ব্যায়াম কিভাবে করবেন
দুহাত মাথার পিছনে নিয়ে ঘাড়ের উপরের অংশে যে গর্ত আছে, ঠিক তার উপরে যে উঁচু জায়গা আছে সেখানে ইনডেক্স ফিংগার দিয়ে ৭০-৭৫ বার মাথায় চাপ দিন। এরপর কপালের দুপাশে ঘষতে হবে (৫-১০) বার। মাথার পেছনে, কানের উপরে ও পাশে কিছু ট্রিগার পয়েন্ট আছে যেগুলোতে ডিপফ্রিকশন করলে অল্প দিনের মধ্যে টিনেটাস থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

টিনেটাস রোগের  সর্তকতা
অনেকেই  না জেনে উচ্চস্বরে হেডফোনে গান শুনি, বাদ্যযন্ত্র বাজাই, পিস্তল এবং মেশিনগান চালাই, এতে টিনিটাস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তাই এসব কাজ করার আগে কানের প্রোটেকশন ব্যবহার করতে হবে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে প্রচুর পানি খেতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ  চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রাখতে পারেন। 

লেখক:
প্রফেসর ডাঃ মোঃ  আবু সালেহ আলমগীর
ব্যাক-পেইন ও পাবলিক হেলথ এবং ডিজঅ্যাবিলিটি ও রি-হ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ

অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান
ডিপার্টমেন্ট অব ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যান্ড রি-হ্যাবিলিটেশন
দ্যি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা

কনসালটেন্ট ও বিভাগীয় প্রধান
ফিজিওথেরাপি মেডিসিন এন্ড রি-হ্যাবিলিটেশন বিভাগ
"এ -ওয়ান হাসপাতাল লিমিটেড, মালিবাগ মোড় ঢাকা"