হৃদরোগ নিরাময়ে ন্যাচারাল বাইপাস চিকিৎসা


লেখকঃ ড. এম এম রহমান
হৃদরোগ নিরাময়ে ন্যাচারাল বাইপাস চিকিৎসা
  • Font increase
  • Font Decrease

পৃথিবীতে যত কারণে মানুষের মৃত্যু হয়, একক কারণ হিসেবে হৃদরোগ সর্বোচ্চ। আমেরিকা যুক্তরাস্ট্রে প্রতি ৪৫ সেকেন্ডে একজন হৃদরোগে মারা যায়। বাংলাদেশে হৃদরোগের হার নিয়ে কোন বিশদ পরিসংখ্যান নেই। শুধু জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা বছরে গড়ে ৩০ হাজার। এছাড়া বছরে এক লাখেরও বেশি রোগী সেখানকার বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রতিবছর হৃদরোগে এক কোটি পঁচাত্তর লাখ মানুষ মারা যায়। যা মোট মৃত্যুর ৩১ শতাংশ আর এর ৮০ শতাংশই স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও বিশেষজ্ঞদের ধারণা এসব দেশের হৃদরোগীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি।

হৃদরোগীদের জন্য বেসরকারি পর্যায়ে গত কয়েক বছরে অনেক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা এ রোগের আধিক্য প্রমাণ করে। ন্যাচারাল বাইপাস বিজ্ঞানভিত্তিক এ রকম এক চিকিৎসা প্রযুক্তি যার কল্যাণে মানুষ দীর্ঘদিনের বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা পেতে পারেন।

ন্যাচারাল বাইপাস: ন্যাচারাল বাইপাস চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক অভিনব আবিষ্কার। হৃদরোগ চিকিৎসায় অত্যাধুনিক ও প্রায় শতভাগ সফল একটি কার্যকর পদ্ধতি। একটা সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমে নূন্যতম ৩৫ টি সেশনে চিকিৎসা নিলে হৃদপিন্ডের অব্যবহৃত সুপ্ত রক্তনালিগুলো সচল হয়ে ওঠে এবং হৃদপিন্ডে রক্ত সরবরাহ বৃদ্ধি করে। এ মেশিনটির নাম ইসিপি (ECP) মেশিন। এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা নিলে কোনো কাঁটা-ছেড়া ছাড়াই হৃদরোগ জনিত বুকব্যথার উপশম হয়। কারণ হৃদপিন্ডের রক্তনালি ব্লকের বাইপাস হয়ে যায়। ইহাকেই আমরা ‘ন্যাচারাল বাইপাস’ বলি। অর্থাৎ ব্লক কিংবা হার্ট এটাক জনিত হৃদরোগের জন্য অন্য কোনো চিকিৎসার (বাইপাস অপারেশন কিংবা রিং বসানোর) প্রয়োজন হবে না।    

যেভাবে ন্যাচারাল বাইপাস করা হয়: ইসিপি মেশিনে প্রতিদিন একঘণ্টা করে মোট ৩০ থেকে ৫০ ঘণ্টা চিকিৎসা নিলে রক্তনালির দেয়ালে রক্ত প্রবাহজনিত তীব্র চাপে প্রদাহ রোধের কার্যকারিতা-(Anti Inflammatory Effect)  বৃদ্ধি পায়। পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ও ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের গবেষকরা তাদের গবেষণায় দেখতে পান, রক্তনালির দেয়ালের গায়ে ব্যায়ামের কারণে বর্ধিত রক্তপ্রবাহে সৃষ্ট  প্রবল রক্তচাপ দীর্ঘকালের প্রদাহ-(Chronic Inflammation) উপশমের জন্য দেয়া ওষুধের প্রদাহ রোধের (Anti Inflammatory) কার্যকারিতা আরও বৃদ্ধি করে। গবেষণায় আরও প্রমাণ হয়, রক্ত প্রবাহজনিত যান্ত্রিকতা নিজেই প্রদাহ রোধক (Anti Inflammatory)। অধিকতর রক্তপ্রবাহ তা ব্যায়ামের মাধ্যমেই হোক বা ইসিপি মেশিনের মাধ্যমেই হোক, রক্তনালিগুলোকে স্বাভাবিকভাবে প্রতিরক্ষা দান করে এবং প্রদাহকে প্রতিরোধ করে, যা কিনা হৃদরোগের অন্যতম কারণ। ইসিপি মেশিন রক্তনালির প্রসারণ ও সংকোচন-(Vascular Reactivity) ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। যে সব ব্যায়াম মানুষের উপকার করে, ইসিপি মেশিন রক্ত সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে একইভাবে স্বাস্থ্যকে উন্নত করে। এটা রক্তনালির ভেতরের আবরণের কোষ-ক্রিয়ার উন্নতি ঘটায়। যার ফলে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বস্তু তৈরি হয়। এক নাইট্রিক অক্সাইড এবং দুই এন্ডোথেলিন। এ দুটি বস্তু রক্তনালির ভেতরের আবরণের কোষগুলোকে সুস্থ রাখে এবং স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে সহায়তা করে।

নাইট্রিক অক্সাইড: নাইট্রিক অক্সাইডকে রক্তনালীকে শীতল(relaxed) করে। ইহা রক্তনালিকে প্রসারিত করার মাধ্যমে রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি করে। রক্তনালির ভেতরের আবরণকে শক্তিশালী করে, যার ফলে রক্তনালির ভেতরের আবরণে রক্তজমাট বাধা, রক্তনালির ফাটল- (Cracking), রক্তনালির সাময়িক সংকোচন (Spasm) ইত্যাদি প্রতিরোগ করে। ফলে রক্তনালি স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে এবং অসুস্থ হয় না। গবেষণায় যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে যে উচ্চ রক্তচাপ, স্থুলতা, অতিরিক্ত চর্বি,বহুমূত্র রোগ, হার্ট ফেইলিউর, এথারো-স্ক্লেরোসিস, বার্ধক্য, রক্তনালির আঘাত ইত্যাদিসহ নানা অবস্থা রক্তনালির ভেতরের আবরণের স্বাভাবিক কাজ করার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে এবং নাইট্রি অক্সইডের মাত্রা কমিয়ে দেয়। যে কোনো কিছু দ্বারা নাইট্রিক অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি করা গেলেই অ্যানজাইনা জাতীয় হৃদরোগে দীর্ঘ মেয়াদি উপকার পাওয়া যায় এবং সমস্ত শরীরের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। এই চিকিৎসা চলাকালিন সময়ে ৬০ শতাংশ এবং চিকিৎসা শেষে পরবর্তী একমাস ২০ শতাংশ হারে নাইট্র অক্সাইডের উৎপাদন মাত্রা বৃদ্ধি করে।

এন্ডোথেলিন: এন্ডোথেলিন নানাভাবে শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব ঘটায়। এটি রক্তনালিকে সংকোচিত করে। হৃদপিন্ডকে অধিকতর বাধার বিপরীতে অতিরিক্ত কাজ করানোর চেষ্টা করে। ফলে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। ইহা শরীর থেকে দুটি হরমোন-এল্ডোস্টারন (Aldosteron) এবং এট্রিওল ন্যাট্রিওরেটিক পেপটাইড (Atriol Natriuretic peptide) মাত্রা বৃদ্ধি করে, যা শরীর থেকে লবণ ও পানি নিঃসরনে বিঘ্ন ঘটায়। ফলে শরীরে লবণ ও পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। তাতে রক্তচাপ বৃদ্ধি ও কনজেস্টিভ হার্ট ফেইলিওর (Congeative Heart Failure) স্থায়ী হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এন্ডোথেলিন উৎপাদন হ্রাসকরণে দীর্ঘায়ু লাভ করে। এই মেশিনে চিকিৎসা চলার সময়ে এন্ডোথেলিন ৪০ শতাংশ এবং চিকিৎসা শেষে একমাস পর্যন্ত ২০ শতাংশ হারে কমতে থাকে। এ মেশিনের চিকিৎসার ফলে রক্তনালীর অন্যতম সংকোচক এনজিওটেনসিল-২ এর মাত্রা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়।

উপরোক্ত চিকিৎসার ধনাত্মক (Positive) প্রভাব ইসিপি মেশিনে চিকিৎসা শুরুর সাথে সাথেই দেখা যায়। যদিও সমান্তরাল পার্শ্ব রক্তনালি-(Collateral blood Vessels ) সৃষ্টি ও তাদের কার্যকারিতা শুরু হতে কয়েক সপ্তাহ সময় লেগে যায়। তবু রক্তনালীর কোষের বায়ো-রসায়নের পরিবর্তন যেমন: নাইট্রিক অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি ও এন্ডোথেলিনের মাত্রা হ্রাস সাথে সাথেই শুরু হওয়ার কারণে রোগীরা এ চিকিৎসা  শুরুর প্রথম সপ্তাহ থেকে অপেক্ষাকৃত সুস্থ বোধ করেন।

বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করুন ০১৮৮৪-৫৫৩৭৭৫ নম্বরে।

লেখকঃ
ডা. এম এম রহমান
গবেষক, চিকিৎসক ও চিফ কন্সালটেন্ট
মাতৃভূমি হার্ট কেয়ার
লেভেল ৬, ১/১, ১ রূপায়ন তাজ, কালভার্ট রোড, নয়াপল্টন (পল্টন টাওয়ারের পাশে), ঢাকা।